এই পোস্টে আমরা আলোচনা করবো প্রাণরসায়নের একটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ নিয়ে, যাকে বলা হয় হোমিওস্ট্যাসিস (Homeostasis)।
জীবনের সাথে সম্পর্কিত করার আগে জেনে নেই শব্দটির অর্থ কি। Homeostasis শব্দটি এসেছে Greek থেকে, যার অর্থ করলে হয় "সমঅবস্থা"। এটি হচ্ছে কোন একটা সিস্টেম বা ব্যবস্থার এমন এক বৈশিষ্ট্য, যার কারণে ওই সিস্টেমের পরিবর্তনশীল বিষয়গুলো এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় যে, সিস্টেমের অভ্যন্তরীণ বা ভিতরের অবস্থা অপরিবর্তিত থাকে, কিংবা একটি নির্দিষ্ট মানের কাছাকাছি থাকে। ব্যাখ্যাটা বেশ জটিল হয়ে গেল? খুব কম কথায় বা সহজে বলতে গেলে হোমিওস্ট্যাসিস হচ্ছে কোন সিস্টেমের অভ্যন্তরীণ অবস্থার নিয়ন্ত্রণ।
হোমিওস্ট্যাসিস-এর ধারণা সর্বপ্রথম দেন ক্লড বার্নাড (Claude Bernard) ১৮৬৫ সালে। তিনি ছিলেন একজন ফ্রেঞ্চ শরীরতত্ত্ববিদ (Physiologist)।
শব্দটির নিজস্ব অর্থ থাকলেও এটি মুলত জীবদের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয় বেশি। আমরা অনেকেই জানি, প্রাণীদেহে তাপমাত্রা, অম্লত্ব বা ক্ষারত্ব (pH), বিভিন্ন আয়ন যেমন সোডিয়াম, পটাশিয়াম বা ক্যালসিয়াম, রক্তে গ্লুকোজ ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের ব্যাপার থাকে এবং স্বাভাবিক অবস্থায় প্রত্যেকের একটা নির্দিষ্ট মাত্রা থাকে। কোন কারণে যদি এদের কোন একটির মাত্রার কোন পরিবর্তন হয়, তবে তাকে আগের অবস্থার কাছাকাছি ফিরিয়ে নেয়ার জন্য আমাদের শরীর প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে। দারুণ না? জীবের এমন ক্ষমতাকেই জীববিজ্ঞানে হোমিওস্ট্যাসিস বলা হয়।
এর মানে এই দাঁড়াচ্ছে, বাহ্যিক কোন প্রভাবে বা অন্য কোন ঘটনায় যদি শরীরের কোন অবস্থার পরিবর্তন ঘটে, তার জন্য আমাদের দেহে এমন কৌশল ঠিক করা আছে যা সেই পরিবর্তনকে কমিয়ে দিতে পারে বা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার জন্য কাজ শুরু করে দেয়।
বোঝাই যাচ্ছে হোমিওস্ট্যাসিস এর উদ্দেশ্য খুবই মহৎ এবং আমাদের জন্য বেশ দরকারীও। একটা উদাহরণ দেই। ধরলাম কোন কারণে আমার ব্লাড প্রেসার বেড়ে গেল। তখন আমার হার্ট কিছুটা স্লো হয়ে ব্লাড প্রেসারটাকে কমিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে।
মজার না ব্যাপারটা? এবার আশা করি কঠিন মনে হচ্ছে না।
হোমিওস্ট্যাসিস মেকানিজমের দুইটা প্রধান অংশ আছে :
১) সেন্সর (Sensor),
২) নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (Control Center)
নাম দিয়েই কাজের ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। সেন্সরের কাজ হচ্ছে পরিবর্তনটাকে সনাক্ত করা, আর কন্ট্রোল সেন্টারের কাজ এমন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাতে পরিবর্তনটা কমে গিয়ে আগের অবস্থায় ফিরে যায়। তখন কিন্তু আর সেন্সর কাজ করে না।
![]() |
Homeostasis Control Mechanism |
ব্লাড প্রেসারের উদাহরণটাই আবার ধরা যাক। ব্লাড প্রেসার বেড়ে গেলে সেন্সর রিসেপ্টর সিগন্যাল পাঠায় ব্রেনের কন্ট্রোল সেন্টারে। তখন সেন্টার ধমনীর দেয়ালে নার্ভ সিগন্যাল পাঠানো বন্ধ করে দেয়, যেন ধমনী কিছুটা শিথিল হতে পারে। তাতে ব্লাড প্রেসার কমে যায়, আর তারপর কন্ট্রোল সেন্টারে সিগন্যাল পাঠানোও বন্ধ হয়ে যায়।
প্রয়োজন বুঝে হোমিওস্ট্যাসিস দুই ধরণের হয়-
(১) নেগেটিভ ফিডব্যাক
(২) পজিটিভ ফিডব্যাক
মজার ব্যাপার হচ্ছে আমরা এই পর্যন্ত যা যা বুঝলাম, বলা যায় তার সবই হোমিওস্ট্যাসিসের নেগেটিভ ফিডব্যাকের কাজ। তার মানে নেগেটিভ ফিডব্যাক হচ্ছে এমন নিয়ন্ত্রণ যা কোন পরিবর্তনকে স্বাভাবিক অবস্থায় বা আইডিয়াল অবস্থায় নিয়ে আসে।
এর আরও একটি সহজ উদাহরণ দেখে নেই। আমাদের শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ করে ব্রেনের হাইপোথ্যালামাস । কোন কারণে যদি তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়, তাহলে ব্রেন ডার্মাল ব্লাড ভেসেলে সিগন্যাল পাঠায়, আর তখন ঘামগ্রন্থি থেকে ঘাম নিঃসৃত হয়। ফলশ্রুতিতে শরীর কিছু তাপ হারায়, আর শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
এবার পজিটিভ ফিডব্যাক নিয়ে কথা বলা যাক। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে এর কাজ নেগেটিভ ফিডব্যাকের উল্টোটা হবে। অর্থাৎ এটি এমনভাবে কাজ করে যাতে যে পরিবর্তনটা হয়েছে তা একই দিকে যেতে থাকে, মানে পজিটিভ ফিডব্যাক পরিবর্তন কমানোর বদলে আরও বাড়িয়ে দেয়!
অদ্ভুত না?
ব্যাপারটা কিন্তু যথেষ্ট ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। যদি আমার জ্বর আসে, পজিটিভ ফিডব্যাক তখন আমার শরীরের তাপমাত্রা আরও বাড়িয়ে দেবে! ফলাফলে মৃত্যুও হতে পারে!
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, যেখানে হোমিওস্ট্যাসিস পড়ে আমরা দেখলাম এটা আমাদের উপকারেই কাজ করে, তাহলে এমন মেকানিজম আমাদের শরীরে কেন যা আমাদের ক্ষতি করবে?
আসলে আমরা এমনভাবেই তৈরি যে আমাদের ভিতরকার প্রতিটি কাজ আমাদের কোন না কোন প্রয়োজনের জন্যই রয়েছে। তেমনিভাবে ক্ষেত্রবিশেষে পজিটিভ ফিডব্যাকও আমাদের প্রয়োজন হয়।
এর খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি উদাহরণ হল প্রসব যন্ত্রণা। যখন কোন মা সন্তান জন্ম দেন, তখন সন্তানের মাথা সারভিক্সে চাপ দেয়, যেখানে সেন্সর রিসেপ্টর থাকে। তাতে ব্রেনে সিগন্যাল যায়, আর ব্রেন পিটুইটারি গ্ল্যান্ডকে নির্দেশ দেয় অক্সিটোসিন নামের এক হরমোন নিঃসরণ করতে। অক্সিটোসিন রক্তের মাধ্যমে এসে জরায়ুকে আরও সঙ্কুচিত করে। তাতে ব্যথা আরও বেড়ে যায়, আর সারভিক্স আরও বেশি উদ্দীপিত হয়। সন্তান জন্মের প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত এই ক্রিয়া চলতে থাকে, অর্থাৎ জরায়ু সঙ্কোচন আরও বাড়তে থাকে, সাথে প্রসব যন্ত্রণাও।
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiH4GpJ2Ee0oHEdM8o7TnlDHn9I20poWfjJv0RfJEz8AiNxUzaffJo0260Afv2rqWLY72Ei-zet20dG3fWxgvTEOzHmovL1b2fFfCyzNbrMKpsn70KeepxHMMHqtEQVUr97oZjzllQJamo/s400/file.jpeg)
তার মানে পজিটিভ ফিডব্যাক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই স্বাভাবিকভাবে একটি সন্তান জন্মের প্রক্রিয়া শেষ হয়। পজিটিভ ফিডব্যাকের গুরুত্ব তাহলে কোন অংশেই কম নয় বোঝা যাচ্ছে।
আশা করছি হোমিওস্ট্যাসিস নিয়ে মোটামুটি একটা ধারণা দিতে পেরেছি এই পোস্টের মাধ্যমে। প্রাণের আরও অনেক রহস্যের সন্ধান পেতে আমাদের সাথেই থাকুন।
আর হ্যাঁ, আপনাদের যেকোনো মতামত আমাদের কাছে মূল্যবান, তাই মতামত জানাতে ভুলবেন না। ভাল থাকুন :)
ছবি - ইন্টারনেট।