এই পোস্টে আমরা আলোচনা করবো সাডেন মেন্টাল স্ট্রেস (Sudden mental stress) , বা হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে সৃষ্টি হওয়া মানসিক চাপে কি কি পরিবর্তন হয় আমাদের শরীরে - এই বিষয়ে।
আমাদের অনেকের জীবনেই স্ট্রেস নিত্যসঙ্গী। আমরা সবাই একাধিকবার স্ট্রেসের মুখোমুখি হয়েছি। তাই আমরা এটাও ফিল করেছি যে, মানসিক চাপে থাকাকালীন সময়ে দুর্বলতা, ক্লান্তি, নিদ্রাহীনতাসহ অনেক শারীরিক পরিবর্তন হয়। কিন্তু কেন?
প্রথমত, স্ট্রেসকে আমরা ২ ভাগে ভাগ করতে পারি।
এক, আপনি ভালই ছিলেন, ঠিকঠাক মতই চলছিল আপনার জীবন। হঠাৎ কোন দুর্ঘটনা, কিংবা আতঙ্ক অথবা কোন অনাকাঙ্ক্ষিত কারণে তৈরি হল মানসিক চাপ। এটাকে বলা হবে Acute stress. অর্থাৎ, Acute stress তৈরি হয় অপ্রতাশিত এবং নতুন কোন নির্দিষ্ট ঘটনা বা পরিস্থিতি থেকে। যেমন, হঠাৎ রোড অ্যাকসিডেন্টের মুখোমুখি হতে গিয়ে বেঁচে যাওয়া, হঠাৎ কোন কারণে ভয় পাওয়া কিংবা প্রথমবারের মত অনেক মানুষের সামনে স্টেজ পারফরমেন্স, অথবা হয়ত কোন সম্পর্কের বিচ্ছেদ। মানে Acute stress হল immediate এবং short term। এজন্য একে "On the spot" টাইপ স্ট্রেসও বলা হয়।
দুই, Chronic stress । Chronic stress তৈরি হয় কোন ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে। যেমন, দীর্ঘদিন ধরে আপনার জীবনে বড় কোন সমস্যা চলছে। অনেকদিন যাবত আপনি মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। অনেকদিন ধরে চলতে থাকা এধরনের স্ট্রেসকে আমরা বলি Chronic stress.
অনেক বিজ্ঞানীরা মনে করেন, আমাদের স্ট্রেস রেসপন্স সিস্টেম (stress response system) দীর্ঘ সময় ধরে সচল থাকতে পারে না। যেহেতু Chronic stress এ বারবার স্ট্রেস রেসপন্স সিস্টেম কাজ করতে থাকে, তাই আমাদের শরীরের স্বাভাবিক অনেক প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে যায়, স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যেতে দেখা যায়। তাই বলা হয় Chronic stress আমাদের শরীর এবং মনে "wear and tear", অর্থাৎ কালক্রমে ধীরে ধীরে ক্ষয় তৈরি করতে পারে।
আবার Chronic stress অনেক ধরণের শারীরিক সমস্যার সাথে সংযোগ তৈরি করতে পারে। যেমন হার্ট ডিজিজ, উচ্চ রক্তচাপ, হাই কোলেস্টেরল, টাইপ টু ডায়বেটিস ইত্যাদি। যেমন, কারো পরিবারে যদি এসব কোন সমস্যার ইতিহাস থেকে থাকে, মানে বংশগত ভাবে এসব কোন একটি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, Chronic stress সেই সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দিতে পারে। আর যদি ইতোমধ্যে এগুলোর কোন একটি থেকে থাকে, তবে Chronic stress হয়ে উঠতে পারে আরও ভয়ংকর!
আবার Chronic stress অনেক ধরণের শারীরিক সমস্যার সাথে সংযোগ তৈরি করতে পারে। যেমন হার্ট ডিজিজ, উচ্চ রক্তচাপ, হাই কোলেস্টেরল, টাইপ টু ডায়বেটিস ইত্যাদি। যেমন, কারো পরিবারে যদি এসব কোন সমস্যার ইতিহাস থেকে থাকে, মানে বংশগত ভাবে এসব কোন একটি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, Chronic stress সেই সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দিতে পারে। আর যদি ইতোমধ্যে এগুলোর কোন একটি থেকে থাকে, তবে Chronic stress হয়ে উঠতে পারে আরও ভয়ংকর!
আমরা মূলত এই পোস্টে Acute stress নিয়ে, এবং তাতে শরীরের কি কি প্রতিক্রিয়া হয়, তা নিয়ে কথা বলব।
স্ট্রেস মানসিক হলেও শরীরের উপর এর অনেক প্রভাব আছে, যেটা হয় মূলত স্ট্রেসকে ম্যানেজ করতে গিয়ে।
Stress factor গুলোকে বলা হয় stressor. স্ট্রেস সৃষ্টি হওয়ার পর আমাদের শরীরের প্রধান উদ্দেশ্য থাকে স্ট্রেস থেকে মুক্ত হওয়া। এ জন্য Acute stress এ এক ধরণের রেসপন্স সিস্টেম কাজ করে যাকে বলা হয় "Fight or Flight" রেসপন্স। অর্থাৎ হয় লড়াই, নয় পলায়ন। এই সিস্টেমে ব্রেন এবং এন্ডোক্রাইন সিস্টেম - দুটোই কাজ করে।
একদিকে সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম, যার অংশ হল ব্রেন এবং স্পাইনাল কর্ড, রেসপন্স শুরু করে। ফলে হার্ট দ্রুত পাম্প করে, রক্তচাপ বেড়ে যায়, কারণ তখন শরীরের বেশি পরিমাণে অক্সিজেন এবং গ্লুকোজ দরকার হয়। শ্বসনের হার বেড়ে গিয়ে টিস্যুতে পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন সরবরাহ করতে, এবং তৈরি হওয়া প্রচুর পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড বের করে দিতে সাহায্য করে। আমরা ভয় পেলে বা আতঙ্কিত হলে কিংবা টেনশন হলে আমাদের হার্টবিট বেড়ে যাওয়ার এই হল এক কারণ।
আবার যাদের Irritable Bowel Syndrome (IBS) আছে, তাদের ক্ষেত্রে স্ট্রেসের প্রভাব রয়েছে। স্ট্রেসড কন্ডিশনে ব্রেন আমাদের অন্ত্রের সাথেও কানেকশন তৈরি করে, যা অন্ত্রের ভিতর দিয়ে খাবার পরিবহনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে, এবং অন্ত্রের সেন্সেটিভিটিকে বাড়িয়ে দেয়। তাছাড়া স্ট্রেসড অবস্থায় অন্ত্রে থাকা ব্যাকটেরিয়াদের কম্পজিশন নষ্ট হয়ে যেতে পারে, যার প্রভাব পড়তে পারে খাবার হজমে।
অন্যদিকে, এন্ডোক্রাইন সিস্টেম কাজ শুরু করে। আমাদের এন্ডোক্রাইন সিস্টেমের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল অ্যাড্রেনাল গ্ল্যান্ড, যা থাকে আমাদের কিডনির ঠিক উপরের দিকে। স্ট্রেস তৈরি হওয়ার পর অ্যাড্রেনাল গ্ল্যান্ড এর অ্যাড্রেনাল মেডুলা থেকে নিঃসৃত হয় catecholamine হরমোন, যাদের নাম এপিনেফ্রিন(epinephrine) এবং নরএপিনেফ্রিন(nor-epinephrine)। এদেরকে adrenaline এবং noradrenaline হরমোনও বলে। এরাই হল রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, হার্ট দ্রুত পাম্প করার ক্ষেত্রে প্রধান কমিউনিকেটর। এরা ব্লাড ভেসেল সংকোচন (vasoconstriction) করে প্রয়োজনীয় অংশে, যেমন ব্রেন এবং মাসলে, অক্সিজেন আর গ্লুকোজ পরিবহন বাড়িয়ে দেয়, এবং একই সাথে যে কাজগুলো acute স্ট্রেসড কন্ডিশনে অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, (যেমন digestion), তাদেরকে সাময়িকভাবে প্রতিহত করে রাখে।
এছাড়াও অ্যাড্রেনাল কর্টেক্স থেকে করটিসল (cortisol) নামে একধরনের স্টেরয়েড জাতীয় হরমোন নিঃসৃত হয়, যা ধারণা করা হয়, অ্যামিনো অ্যাসিড আর ফ্যাট সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়, যেন ওই মুহূর্তে প্রয়োজনীয় অন্যান্য উপাদান, যেমন গ্লুকোজ, তৈরি হতে পারে, এবং এনার্জি সাপ্লাই করতে পারে। আবার cortisol নিঃসরণ হওয়ার পর ব্লাড ভেসেলের এন্ডোথ্যালিয়াম সেলগুলো (যারা ব্লাড ভেসেলের ভিতরের ত্বক তৈরি করে) ঠিকমত কাজ করতে পারে না, যাকে এখন বিজ্ঞানীরা atherosclerosis (cholesterol deposition in artery) শুরু হওয়ার প্রথম ধাপ বলে মনে করেন। যা থেকে পরবর্তীতে হার্ট অ্যাটাক, বা স্ট্রোক পর্যন্ত হতে পারে!
Cortisol আরেকধরনের কাজও করে। স্ট্রেসড অবস্থায় অনেকে তুলনামূলক বেশি পরিমাণে খায়, বা খাওয়ার ইচ্ছা অনুভব করে। এর পেছনে ভূমিকা আছে cortisol এর! Cortisol শরীরকে নতুন করে এনার্জি সোর্স তৈরি করতে সিগন্যাল দেয়, এবং এনার্জি সমৃদ্ধ খাবার, যেমন ফ্যাট জাতীয় খাবার খেতে প্রভাবিত করে।
"Fight or Flight" রেসপন্স ছাড়াও আরেক ধরণের রেসপন্স দেখা যায় স্ট্রেস সৃষ্টি হলে, যাকে বলা হয় "Tend and Befriend" রেসপন্স।
"Tend and Befriend" রেসপন্সে অক্সিটোসিন (oxytocin) নামক এক হরমোন নিঃসৃত হয়। এই রেসপন্সে কাজটা হয় আগের রেসপন্সের বিপরীত। এবার আর যুদ্ধ বা পালিয়ে বেড়ানো নয়। এই রেসপন্স মানিয়ে নেয়ার।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, "Fight or Flight" রেসপন্সকে পুরুষদের প্রাইমারী রেসপন্স বলা হয়, এবং নারীরা "Tend and Befriend" রেসপন্স বেশি প্রদর্শন করেন। এটি শুধু সাইকোলজিক্যাল নয়, এর বায়োকেমিক্যাল ব্যাখ্যাও রয়েছে।
মেয়েদের এস্ট্রোজেন (Estrogen) নামের এক হরমোন থাকে, যা মূলত female sex hormone। এই এস্ট্রোজেন অক্সিটোসিনের প্রভাবকে বাড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। তাই দেখা যায় নারীরা স্ট্রেসড কন্ডিশনে পুরুষদের তুলনায় বেশি কোমল এবং বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করে থাকেন।
স্ট্রেসড অবস্থায় নারীদের এই যত্নবান আচরণ তাদের সন্তানদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়। সন্তানদের প্রতি মায়েদের এই বেশি কেয়ারিং, তাদের স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে!
আবার যখন কোন মহিলা স্ট্রেসড থাকেন, "Tend and Befriend" রেসপন্সে দেখা যায় তিনি স্ট্রেস ম্যানেজ করতে বেশি পরিমাণ সামাজিক আচরণ করেন, অন্যান্য মহিলাদের সাথে মিশতে চান। রিসার্চ বলছে, স্ট্রেসে থাকাকালীন মহিলারা পুরুষদের তুলনায় বন্ধু এবং পরিবারের সঙ্গ বেশি করে পেতে চান। এমনকি কর্মস্থলে কাজের চাপ কিংবা অন্যান্য সমস্যা থাকার সময় মায়েদের তাদের সন্তানদের প্রতি বেশি যত্নশীল হতে দেখা যায়, যেখানে একই পরিস্থিতিতে বাবারা পরিবারের সাথে দূরত্ব রেখে চলতে পছন্দ করেন!
এর সবই "Tend and Befriend" রেসপন্সের কারসাজি।
Hans Selye নামের একজন স্ট্রেসের ক্ষেত্রে একটি নতুন টার্ম ব্যবহার করেছেন, যাকে বলা হয় General Adaptation Syndrome (G.A.S.)। এতে তিনি তিনটি স্টেজের কথা বলেছেন।
প্রথমত, Alarm stage। এই স্টেজে বডি প্রাথমিক রেসপন্স শুরু করে, যেমন হার্টবিট বেড়ে যাওয়া, fight কিংবা flight এর জন্য প্রস্তুত হওয়া ইত্যাদি।
দ্বিতীয়ত, Resistance stage, যাতে শরীর প্রতিরোধ করতে শুরু করে স্ট্রেসড কন্ডিশনকে। যেমন ব্লাড প্রেসার বেড়ে যাওয়া, তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া, স্ট্রেস হরমোন নিঃসরণ ইত্যাদি।
শেষ স্টেজ হচ্ছে, Exhaustion stage। এই স্টেজে আমাদের সবধরনের শারীরিক প্রতিক্রিয়ার ফলাফল হিসেবে অবসাদ সৃষ্টি হয়, ক্লান্তি অনুভূত হয়।
আমরা সবাই লাইফে অনেকবার অনেক মানসিক চাপের সম্মুখীন হই, তার প্রভাব শুধু মনে হয়, পড়ে আমাদের শরীরেও। কিভাবে আমাদের শরীর সেই স্ট্রেসকে কন্ট্রোল করে তা নিয়ে এই ছিল প্রাথমিক কিছু ধারণা।
পরবর্তী কোন পোস্টে কথা হবে জীবনের অন্য কোন মজার রহস্য নিয়ে। ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন, চিন্তামুক্ত জীবনযাপনের চেষ্টা করুন। যেকোনো ধরণের মতামত জানান।
ধন্যবাদ :)
কৃতজ্ঞতা (reference) - Khan academy, Wikipedia, Youtube
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন