রক্ত আমরা সবাই চিনি। শরীরের কোথাও কেটে গেলে টকটকে লাল রঙের যে তরল পদার্থ বের হয়ে আসে সেটাই রক্ত। রক্ত আমাদের হৃৎপিণ্ড থেকে শরীরের বিভিন্ন অংশে যায়, আবার সেসব অংশ থেকে হৃৎপিণ্ডে ফিরে আসে। আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, রক্ত হৃৎপিণ্ড থেকে অক্সিজেন নিয়ে ধমনীর মাধ্যমে সারা শরীরে অক্সিজেন বিলি করে বেড়ায়, আবার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড সংগ্রহ করে শিরার মাধ্যমে হৃৎপিণ্ডে ফেরত নিয়ে আসে। এভাবে আমাদের সারা দেহে রক্ত ঘোরাফেরা করে অক্সিজেন, কার্বন ডাইঅক্সাইড এবং অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় বর্জ্য পদার্থ পরিবহনসহ আরও অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে চলে, যা আমরা টেরই পাই না!
এই রক্ত আসলে কি? আমরা আজকে জানবো রক্তের ভিতরে আসলে কি কি থাকে যার কারনে এত কাজ সে করতে পারে। কি রহস্য লুকিয়ে আছে লাল রঙের এই তরলে চলুন তাহলে এবার দেখা যাক।
রক্তের ভিতরে কি আছে তা জানতে হলে আমাদের কিছু পরিমান রক্ত দরকার। ধরে নিচ্ছি আমার শরীর থেকে কিছু রক্ত ইনজেকশন দিয়ে বের করে নিলাম। এই রক্তে কি কি উপাদান আছে তা আসলে আলাদা করা সহজ নয়। রক্তে যা যা থাকে তা এমনভাবে মিশে থাকে যে খালি চোখ দিয়ে আলাদা ভাবে কিছু দেখা সম্ভব না। সেজন্য বায়োকেমিস্টরা এক ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করে, যার নাম সেন্ট্রিফিউগাল যন্ত্র (Centrifugal machine)। টেস্টটিউবে রক্ত নিয়ে এই যন্ত্রে দিলে এটা এত স্পীডে ঘুরতে পারে যে (মিনিটে প্রায় ৩০০০ বার!!!) কিছুক্ষনের মধ্যে রক্ত দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়, যার নিচের ভাগে রক্তের ভারী উপাদানগুলো জমা হয়, আর হালকা উপাদানগুলো উপরের স্তরে থাকে। এই পদ্ধতিটিকে বলা হয় সেন্ট্রিফিউগেশন (Centrifugation)। এই নামকরনের কারণ যন্ত্রটি কাজ করে centrifugal force সৃষ্টির মাধ্যমে।
![]() |
Centrifiged blood sample |
ধরে নিচ্ছি আমার রক্ত স্বাভাবিক এবং আমার রক্তজনিত কোন সমস্যা নেই। স্বাভাবিক কোন মানুষের রক্ত সেন্ট্রিফিউগেশন করলে দেখা যাবে, যে টেস্টটিউবে তার রক্ত রাখা হয়েছিল তা দুইভাগে ভাগ হয়ে গেছে এবং উপরের অংশের রঙ হালকা হলুদ ও এর পরিমাণ (প্রায় ৫৫%) নিচের গাঢ় লাল অংশের (প্রায় ৪৫%) চেয়ে কিছুটা বেশি।
রক্তের উপরের এই হালকা হলুদ রঙের কম ঘনত্বের অংশটিকে বলা হয় রক্তরস বা প্লাজমা (Plasma)। প্রথমে দেখি এই প্লাজমাতে কি কি আছে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে আমরা যদি প্লাজমা থেকে এক ফোঁটা নিয়ে ভালভাবে দেখি, তাহলে দেখতে পাব এর ৯০% ই পানি! (তার মানে রক্তের বেশিরভাগ অংশ জুড়ে যে প্লাজমা রয়েছে, তার বেশিরভাগটুকুই পানি!!) প্লাজমার বাকি ১০% এর মধ্যে ৮% ই হচ্ছে বিভিন্ন প্রোটিন। এর মাঝে একটি প্রোটিন হচ্ছে অ্যালবুমিন (Albumin)। প্লাজমার এই অ্যালবুমিন রক্তকে শিরা বা ধমনীর ভিতরে রাখতে সাহায্য করে বা বলা যায় বের হয়ে যাওয়া থেকে আটকায়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন হল অ্যান্টিবডি (antibody)। আমরা অনেকেই জানি অ্যান্টিবডি কি কাজ করে। এতে রোগ প্রতিরোধের উপাদান থাকে, যা আমাদের ইনফেকশন হওয়া থেকে বাঁচায়, রোগ-বালাইয়ের হাত থেকে রক্ষা করে। আরও একটি দরকারি প্রোটিন থাকে প্লাজমাতে, যার নাম ফাইব্রিনোজেন (Fibrinogen)। হাত বা পা কেঁটে গেলে আমরা দেখি কিছুক্ষণের মধ্যে বের হওয়া রক্ত জমাট বেঁধে রক্ত পড়া বন্ধ করে দেয়। এই জমাট বাঁধার পেছনে রয়েছে ফাইব্রিনোজেনের ভূমিকা।
প্রোটিনের পর প্লাজমার বাকি ২% অংশে থাকে ইনসুলিনের মত কিছু হরমোন, থাকে ইলেক্ট্রোলাইটস যেমন সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ক্লোরিন ইত্যাদি, থাকে গ্লুকোজ, অ্যামিনো অ্যাসিড, লবণ, স্নেহপদার্থ, ভিটামিন ইত্যাদির মত নিউট্রিয়েন্টস।
এই এত্তকিছু মিলেই আমাদের রক্তের প্লাজমা।
(সেরাম (Serum) শব্দটা আমরা রক্তের ক্ষেত্রে অনেকসময় শুনতে পাই। এটা কি জিনিস? মজার ব্যাপার হচ্ছে, সেরাম আর প্লাজমা কিন্তু একই বলা যেত, শুধু যদি একটা ছোট্ট পার্থক্য না থাকতো এদের। আসলে প্লাজমা থেকে ফাইব্রিনোজেন বা রক্ত জমাট বাঁধার জন্য দায়ী অন্যান্য উপাদান বাদ দিলে যা থাকবে সেটাই সেরাম!!)
প্লাজমা নিয়ে অনেক কথা তো হল। এবার তাহলে আমাদের টেস্টটিউবের নিচে জমা হওয়া রক্তের গাঢ় ঘন অংশে কি কি আছে জেনে নেই।
এই অংশে থাকে রক্তের সব কোষগুলো, যাকে বলা যায় রক্তকণিকা (Blood corpuscles)। মোট তিন ধরনের রক্তকণিকা আছে আমাদের।
![]() |
Blood corpuscles |
- লোহিত রক্তকণিকা বা Red blood cell (RBC) বা Erythrocyte
- শ্বেত রক্তকণিকা বা White blood cell (WBC) বা Leucocyte
- অণুচক্রিকা বা Plateles বা Thrombocyte
এবার আসি এর পরের সবচেয়ে ঘন যে অংশ থাকে টেস্টটিউবের সবচেয়ে নিচে (প্রায় ৪৫%)। এরা হচ্ছে লোহিত রক্তকণিকা বা Red blood cell। এই লোহিত রক্তকণিকাতেই থাকে হিমোগ্লোবিন (হিমোগ্লোবিন নিয়ে বিস্তারিত আমাদের অন্য একটি পোস্টে আলোচনা করা হয়েছে। আশা করি সেখান থেকে হিমোগ্লোবিন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারনা পাবেন)। হিমোগ্লোবিন কিন্তু একটি প্রোটিন। (তার মানে শুধু যে প্লাজমাতেই প্রোটিন থাকে, ব্যাপারটা কিন্তু তেমন নয়। লোহিত রক্তকণিকা এবং শ্বেত রক্তকণিকাতেও অনেক প্রোটিন থাকে।)
লোহিত রক্তকণিকা রক্তের একটা বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশ, কারণ এরাই অক্সিজেন পরিবহন করে (যখন যেখানে দরকার)। যেহেতু আমরা বেঁচে থাকি অক্সিজেনের উপর নির্ভর করে, আর এই অক্সিজেন আমাদের প্রয়োজনমত শরীরের বিভিন্ন অংশে সরবরাহ করে লোহিত রক্তকণিকা, তাই আমরা লোহিত রক্তকণিকার কাছে চিরঋণী। আর আমাদের রক্তের রঙ যে লাল, তার কারণ এই লোহিত রক্তকণিকা, বা আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে লোহিত রক্তকণিকার ভিতরে থাকা হিমোগ্লোবিন।
রক্তে লোহিত রক্তকণিকার শতকরা পরিমাণকে বলা হয় হেমাটোক্রিট (Hematocrit)। তার মানে বোঝা গেল স্বাভাবিক কোন মানুষের হেমাটোক্রিট ৪৫% (পুরুষের ক্ষেত্রে ৪৫%, নারীদের ক্ষেত্রে ৪০%)। রক্ত পরীক্ষায় এই হেমাটোক্রিটের পরিমাণ ঠিক আছে কিনা জেনে নেওয়া হয়, কারণ এর তারতম্য বিভিন্ন রোগের কারণ হতে পারে।
এই হল সংক্ষেপে আমাদের রক্তের ভিতরকার সব রহস্য। এই সব উপাদান মিশে তৈরি হয় রক্ত।
অনেককিছু বলে ফেললাম আজ রক্ত নিয়ে। আজ আর না। রক্ত সম্পর্কিত কিছু তথ্য দিয়ে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা এখানেই শেষ করছি।
- পূর্ণবয়স্ক সুস্থ মানুষের দেহে গড়ে প্রায় ৫-৬ লিটার রক্ত থাকে (মানুষের শরীরের মোট ওজনের প্রায় ৮%!)।
- রক্ত সামান্য ক্ষারীয়। এর pH মাত্রা গড়ে ৭.৩৬-৭.৪৫ এবং সজীব রক্তের তাপমাত্রা ৩৬-৩৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস।
- সুস্থ দেহে প্রতি ১০০ মিলিমিটার রক্তে ১৫ গ্রাম হিমোগ্লোবিন থাকে।
- পূর্ণবয়স্ক পুরুষে প্রতি কিউবিক মিলিমিটার রক্তে লোহিত রক্তকণিকার সংখ্যা ৫০ লক্ষ এবং পূর্ণবয়স্ক নারীদের প্রতি কিউবিক মিলিমিটার রক্তে লোহিত রক্তকণিকার সংখ্যা ৪৫ লক্ষ।
- প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি লোহিত রক্তকণিকা থাকলে (৬৫ লক্ষের বেশি) তাকে বলা হয় পলিসাইথেমিয়া (Polycythemia)। আবার উল্টোটা হলে, মানে লোহিত রক্তকণিকা অনেক কম থাকলে (৫০ লক্ষের চেয়ে ২৫% কম) তাকে রক্তাল্পতা বা anemia বলা হয়।
- মানুষের লোহিত রক্তকণিকার গড় আয়ু ১২০ দিন (৪ মাস)। (এ কারণেই প্রতি ৪ মাস পর পর নির্দিষ্ট পরিমাণ রক্ত দান করা সম্ভব, এবং এতে কোন ক্ষতি হয় না বরং অনেক উপকার হয়।)
- পূর্ণবয়স্ক মানুষের প্রতি কিউবিক মিলিমিটার রক্তে শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা ৫-৮ হাজার।
- শ্বেত রক্তকণিকার গড় আয়ু ১-১৫ দিন।
- পূর্ণবয়স্ক মানুষের প্রতি কিউবিক মিলিমিটার রক্তে অণুচক্রিকার সংখ্যা ২.৫-৫ লক্ষ।
- অণুচক্রিকার গড় আয়ু ৫-১০ দিন।
- অণুচক্রিকার সংখ্যা বেড়ে গেলে তাকে থ্রম্বোসাইটোসিস বলে।
- বেশ কিছু মাকশড়া, অক্টোপাস, স্কুইড রয়েছে যাদের রক্তের রঙ নীল। আবার কিছু মাকড়শা রয়েছে যাদের রক্তের রঙ সবুজ বা বেগুনী হয়ে থাকে। অনেক প্রজাপতির রক্তের রঙ হলদেটে হয়। টিকটিকির রক্ত কিন্তু সাদা রঙের!
- রক্তে ০.২ মিলিগ্রাম স্বর্ণ আছে!
- অন্যান্য রক্তকণিকার মত লোহিত রক্তকণিকায় কোন নিউক্লিয়াস, রাইবোসোম নেই।
এই আলোচনা এখানেই শেষ করছি। আমাদের পোস্ট আপনাদের ভাল লাগলে বা কোন উপকারে আসলে তবেই আমাদের এই ব্লগের সার্থকতা। যেকোনো মতামত বা সমালোচনা আমাদের জানাতে পারেন মন্তব্যের মাধ্যমে। ভাল থাকবেন :)
কৃতজ্ঞতা (references) - উচ্চ মাধ্যমিক জীববিজ্ঞান (প্রাণীবিজ্ঞান)- গাজী আজমল এবং গাজী আসমত, উইকিপিডিয়া, খান একাডেমী, প্রিয়.কম।
ছবি কৃতজ্ঞতা - ইন্টারনেট
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন